জেমস আব্দুর রহিম রানা: চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, রক্তপাত ও প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ নিয়ে ইসি ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর মহলকেও ভাবিয়ে তুলেছে। এমনকি খোদ সরকারি দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেও উদ্বিগ্ন।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপসহ পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে সহিংসতা ঠেকাতে আরো কঠোর হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে সোমবার রাত থেকে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান। প্রথম পর্যায়ে টানা সাত দিন চলবে। নির্বাচনী এলাকায় বৈধ অস্ত্রও প্রদর্শন করা যাবে না মর্মে সকল জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ওসিদের কাছে পুলিশ সদর দফতর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভোটের পরিবেশ বিঘ্নের অপচেষ্টাকারী সরকারদলীয় আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থীদেরও ছাড় মিলবে না। ইসি ও সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এমন কড়া বার্তা পাঠানো হয়েছে মাঠ প্রশাসনে। এরপর র‍্যাবের সদর দফতর থেকেও কড়া নির্দেশ গেছে মাঠপর্যায়ে।
এর আগে ইউপি নির্বাচনের পূর্বাপর এ সংক্রান্ত সব মৃত্যুর খবর নির্বাচনী সহিংসতায় কিনা তা তদন্তের দাবি রাখে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও বৈধ অস্ত্র যেন প্রদর্শন না হয় সেজন্য গত রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। মূলত এরপরই শুরু হয়েছে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেফতার অভিযান। সোমবার বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশন (সিইসি)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চলমান ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতায় সারাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ জন ব্যক্তির প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন সাতজন ও প্রথম ধাপের নির্বাচনের দিন প্রতিপক্ষের হামলায় পাঁচজন প্রাণ হারান। বাকিরা নিহত হয়েছেন নির্বাচনের আগে পরে। স্থানীয় পর্যায়ের এ নির্বাচনে সহিংসতায় প্রতিপক্ষের হামলা-সংঘর্ষে আহত হয়েছেন আরো কয়েক শ’ ব্যক্তি।
ফলে এ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় সংঘাত, সহিংসতা ও অবৈধ অস্ত্রের লাগাম টেনে ধরতে সামনে আরো কঠোর হবে মাঠ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। প্রার্থীদের নিজস্ব কেন্দ্রসহ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি পুলিশ ও আনসার মোতায়েন করা হবে। একই সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার ঠেকাতে ও ক্যাডার নেতাদের গতিবিধি নজরে রাখতে গোয়ে
এদিকে স্থানীয়ভাবে প্রার্থীদের প্রভাব বিস্তারের কারণেই ইউপি নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। গত বৃহস্পতিবার হওয়া দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে প্রথম দফাকেও—যা নিয়ে উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগের কেন্ত্রীয় নেতারা। তবে এর জন্য স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব বিস্তারের সংস্কৃতিকেই দুষছেন তারা।
দ্বিতীয় দফার ইউপি নির্বাচনে বেশিরভাগ এলাকাতেই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে কেন্ত্র মনোনীত প্রার্থীরা ধরাশায়ী হলেও এটিকে পরাজয় হিসেবে দেখছে না ক্ষমতাসীনরা।
বিদ্রোহী হলে দল থেকে বহিষ্কারের কঠোর সিদ্ধান্ত থেকেও সরে এসেছে ক্ষমতাসীনরা। তবে নির্বাচনে সবাইকে মনোনয়নপত্র কেনার সুযোগ দিয়েও সংঘাত-সহিংসতা ঠেকানো যাচ্ছে না। আগামীতে তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের নির্বাচন নিয়েও শঙ্কিত।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন্স) মো. হায়দার আলী খান জানান, ইউপি নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তৃতীয় ধাপের নির্বাচন সুষ্ঠু ও পরিবেশ নির্বিঘ্ন রাখতে পুলিশের তরফ থেকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ হানাহানি কিংবা প্রাণহানি চায় না। যদিও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া পুলিশের একটি রুটিন কার্যক্রম।
দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের আগে ইসি জানিয়েছিল, ওই নির্বাচন উপলক্ষে আইন-শৃঙ্খলা সমন্বয় ও মনিটরিং সেল গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধির সমন্বয়ে এ সেল গঠন করা হয়েছে। ইসি এক আদেশে এ তথ্য জানানো হয়। ইসি কর্মকর্তারা জানান, মনিটরিং সেলের প্রধান করা হয়েছে আইডিয়া প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদেরকে।
এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা, পুলিশের এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা, বিজিবি ও র্যাবের অতিরিক্ত পরিচালক, মেজর, আনসার ও ভিডিপির মেজর অথবা উপ-পরিচালক কর্মকর্তা এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অথবা সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা মনিটরিং সেলের কমিটিতে থাকবেন। ভোটগ্রহণের দিন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মনিটরিং সেলের কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে পরিচালিত হবে। এরপরও ওই নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ঘটায় পরবর্তীর জন্য আরো কঠোর হতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ইসি নির্দেশ দিয়েছে ইসি।
এদিকে স্থানীয় সরকারের সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে থাকার মতো অবস্থায়। আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে রয়েছে। এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘আমার অঞ্চলভিত্তিক কথা বলা ঠিক হবে না। কিন্তু যেসব এলাকায় এসব ঘটনা (সহিংসতা) ঘটেছে, সেগুলো আসলেই একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জায়গা। এসব জায়গায় এ রকম ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, ‘উনি যে কথাগুলো ব্যবহার করেছেন, সেগুলো শালীনতা বহির্ভূত।
আইসিইউ, লাইফ সাপোর্ট-এ কথাগুলো শালীন মনে করি না।’
জানা গেছে, আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের ১০০৭টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচনেও কয়েকটি জেলায় সংঘর্ষ ও প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে গোয়েন্দাদের। এরই মধ্যে কিছু জায়গায় প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ছোট-খাটো মারামারির খবর মিলছে। তাই আগ থেকে থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নিতে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।